আমেরিকা ভ্রমন, পর্ব- ১ জর্জিয়ার হেলেন: এক রূপকথার ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশিত: ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২৫ ড. মো. রাকিবুল ইসলাম: আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের উত্তরে আল্পসের গহীনে ছোট্ট এক শহর হেলেন। আটলান্টা শহর থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত হেলেনকে প্রথম দেখায় মনে হবে, এটি যেন কোনো আমেরিকান শহর নয়, বরং একটি ইউরোপীয় বাভারিয়ান গ্রাম। চারপাশে পাহাড়ের কোল, চাট্টানগুলোর ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, আর বাভারিয়ান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বাড়িঘর—সব মিলিয়ে হেলেন যেন এক রূপকথার শহর। ৭ অক্টোবর, ২০২৪ স্নিগ্ধ এক সকালে আমরা রওনা দিলাম আটলান্টা শহর থেকে। গাড়ি চালিয়ে চলেছি প্রকৃতির এক মনোমুগ্ধকর পথ ধরে। গাড়ির স্টিয়ারিং হাবিব ইউসুফ রহমতউল্লাহ ভাইয়ের (মাহমুদা আপার জান) হাতে, পিছনের সিটে মাহমুদা আপা ও তাঁর বান্ধবী রোজিনা আপা। গাড়িতে হাবিব ভাই আর রোজিনা আপার রসিকতা শুনতে শুনতে, দুই পাশের সবুজ গাছপালা, উঁচু-নিচু পাহাড়ের মাঝে মাঝে উঁকি দেওয়া ছোট ছোট গ্রাম দেখতে দেখতে কখন যে দুই ঘণ্টার পথ পেরিয়ে গেলাম, টেরই পাইনি। দূর থেকেই দেখতে পেলাম হেলেনের রঙিন ঘরবাড়ি আর উঁচু টাইলের ছাদ। শহরের প্রবেশপথে পা রেখেই মনে হলো যেন এক নতুন দুনিয়ায় এসে পড়েছি। শহরের প্রতিটি কোণ বাভারিয়ার স্থাপত্যের সৌন্দর্যে ভরা। লাল টাইলের ছাদ আর কাঠের কারুকাজ করা বাড়িগুলো যেন ছবির মতো সুন্দর। রাস্তাগুলোতে ঝুলছে জার্মান স্টাইলে সাজানো লণ্ঠন। দোকানপাট থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, এমনকি ছোট কফি শপগুলোতেও ইউরোপীয় ছোঁয়া। হেঁটে হেঁটে শহর ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল, যেন জার্মানির কোনো ছোট্ট গ্রামে ঘুরছি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম স্থানীয় দোকানগুলোর সামনেই সাজানো আছে হস্তশিল্প আর স্মারক সামগ্রী। কাঠের তৈরি কারুকাজ, জার্মান কাচের গয়না আর হাতে বানানো চকলেট, আইসক্রিম—সবই এক কথায় অসাধারণ। শহরের বিভিন্ন দোকানে ঢুঁ মারতে মারতে সময় কখন পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। হেলেন শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চাট্টাহুচি নদী। নদীর ধারে বসে থাকার সময় পানির শব্দ আর পাখির কিচিরমিচির এক মনোরম পরিবেশ তৈরি করে। পর্যটকরা নদীতে রিভার টিউবিং করতে মুখিয়ে থাকে। ঠাণ্ডা পানিতে ভেসে ভেসে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করার মজাই আলাদা। গ্রীষ্মকালে এই অভিজ্ঞতা সত্যিই অনন্য। নদীর ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখার সময় আকাশের লালচে আভা আর নদীর পানিতে তার প্রতিবিম্ব যেন পুরো পরিবেশকে মায়াময় করে তুলে। হেলেনে এসে কেউ বাভারিয়ান খাবারের স্বাদ নিতে ভুলে না। শহরের একটি ছোট রেস্তোরাঁয় বসে ব্রেটজেল, সসেজ, আর সাউয়ারক্রাউট সত্যই অসাধারণ। স্থানীয় স্টাইলের চকলেট আর কফি ছিল অনবদ্য। প্রতিটি খাবারে যেন ছিল ইউরোপীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া। হেলেনের ছোট্ট দোকানগুলো পর্যটকদের জন্য নানা ধরনের স্মারক এবং হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে রাখে। স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি হস্তনির্মিত পণ্য, কাঠের কারুকাজ, জার্মান কাচের গয়না ইত্যাদি সংগ্রহ করা যায়। শহরের আরেকটি জনপ্রিয় জায়গা হলো চকলেটের দোকান। হাতে তৈরি চকলেটের গন্ধ পুরো জায়গাটিকে মিষ্টি করে তুলেছিল। চকলেটের দোকানগুলোতে গেলে আপনি পাবেন বিভিন্ন ধরনের হাতে তৈরি চকলেট এবং মিষ্টান্ন। বাইকপ্রেমীদের জন্য রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ—বিশ্বের সব নামিদামি ব্র্যান্ডের লোভনীয় মোটরবাইক। চাইলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া নিয়ে পুরো হেলেন শহর চক্কর দিয়ে আসা যায় অনায়াসে। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য রয়েছে টয়ট্রেনেরও ব্যবস্থা। এছাড়া, হেলেন থেকে খুব কাছে আনিকাহি স্টেট পার্ক এবং সাউকি মাউন্টেনের মতো প্রাকৃতিক স্থানগুলো অবস্থিত। পাহাড়ে ট্রেকিং, ঝরনার ধারে পিকনিক কিংবা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এই জায়গাগুলো আদর্শ। শরতের সময় এই পার্কগুলো যেন রঙের উৎসবে পরিণত হয়। লাল, কমলা, হলুদ রঙে মোড়ানো গাছপালার দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। হেলেন শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, এর উৎসবমুখর পরিবেশও মন কেড়ে নেয়। আমরা শুনেছিলাম অক্টোবরফেস্টের সময় পুরো শহর যেন উৎসবে মেতে ওঠে। যদিও আমরা সেই সময়টাতে যেতে পারিনি, তবে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানলাম, ঐ সময় জার্মান সংস্কৃতির এক বিশাল উদযাপন হয়। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, পোলকা নাচ আর জার্মান খাবারের উৎসব শহরের রঙ আরও বাড়িয়ে তোলে। হেলেন শহরটি শুধু ভ্রমণকারীদের জন্য নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যও গর্বের জায়গা। এটি জর্জিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং স্থানীয় জনগণের জীবনে আনন্দের সঞ্চার করে। হেলেন আমাদের মনে আজীবন থেকে যাবে। এর বাভারিয়ান স্থাপত্য, চাট্টাহুচি নদীর স্নিগ্ধতা আর আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। এটি যেন এক রূপকথার গ্রাম, যেখানে প্রকৃতি আর সংস্কৃতি হাত ধরে চলে। শহরের উষ্ণ আতিথেয়তা আর সৌন্দর্য ভ্রমণকারীদের স্মৃতিতে বিশেষ স্থান করে নেয়। যদি কখনো আমেরিকায় গিয়ে আপনার ইউরোপীয় সংস্কৃতির স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে হয়, তবে হেলেনই হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য। আমাদের এই ভ্রমণ সত্যিই অনন্য এবং মনোমুগ্ধকর ছিল। SHARES অন্যান্য বিষয়: